পাটকল বন্ধে কৃষকেরও লোকসান


হঠাৎ পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে আমাদের পেটে লাথি মারা কেন?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এই প্রশ্ন করেছেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম।


এবার বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু ভরা মৌসুমে একসঙ্গে এত পাটকল বন্ধ হওয়ায় ফসলের দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, বর্তমানে দেশে সাইফুলের মতো পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান .২৬ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা . শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়, এর থেকে কম বেশি ৮০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে।

দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি পাটের চাষ হয়। পাবনায় এবার ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে; গতবার হয়েছিল ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে।

সাইফুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতবার ২১০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছিলাম। সে আশায় এবার একটু বেশি জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। এখন শুনছি, এবার পাটের দাম পাওয়া যাবে না। তাহলে আমাদের কী হবে?”

 

দেশে পাটচাষির সংখ্যা ২০ লাখের মতো।

সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে।

পাটনির্ভর এই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে; সবগুলোই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে সচল রয়েছে, ১৩টি।

দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি খাতের জুট মিল করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। পারটেক্স গ্রুপের পারটেক্স জুট মিলও এই জেলাতেই অবস্থিত।

গত মৌসুমে দাম ভালো পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি জমিতে পাটের চাষ করেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি বলেন, এই মৌসুমে এখনও পাট উঠা শুরু হয়নি।

পাশের জেলা রাজবাড়ীতে এবার ৪৭ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোপাল কৃষ্ণ দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই জেলায় পাট কাটা শুরু হয়েছে। তবে হাট-বাজারে এখনও বিক্রি শুরু হয়নি।

মানিকগঞ্জে এবার ৩৬ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গতবার হয়েছিল ৩৪ হেক্টর জমিতে।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত।

গতবার দাম বেশি পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি জমিতে পাট চাষ করেছেন বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাদের।

এই জেলায় পাট উঠতে শুরু করেছে। বাজারে প্রতি মণ পাট ১৮০০ টাকা থেকে ১৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবার বিক্রি হয়েছিল ২২০০ টাকা পর্যন্ত।

দাম কমায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মানিকগঞ্জের কৃষক শহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার পাটের দাম নাই। সরকার মিল বন্ধ করে দিয়েছে। আরও কমবে নাকি শোনা যাচ্ছে। তাহলে আমাদের কী হবে?

প্রতি মণ পাট উৎপাদনেই দেড় হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। লাভই যদি না হয় তাহলে মানুষ পাট চাষ করবে কেন?”

কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামানের আশঙ্কা, মৌসুমের ঠিক আগে আকস্মিক পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো কৃষিতে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমন সময়ে সরকার পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল, যখন কয়েক দিন পরেই নতুন পাট বাজারে আসবে। এতে চাষি পাটের উৎপাদন খরচ পাবে না। দেশে এখন বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানার পাটকল আছে। তারা মিলের জন্য পাট খরিদ করবে, কিন্তু দাম দেবে না।

চাষিরা হাটবাজারে এসে পাটের দাম না পেয়ে আহাজারি করবেন। অনেক চাষি হয়ত রাগে পাটে আগুন লাগিয়ে দেবেন। এই হল আসছে পাট মৌসুমের চিত্র।

দেশে মোট ৩১৪টি পাটকলের মধ্যে ৬৩টি বন্ধ থাকার কথা গত বছর সংসদে জানিয়েছিলেন বস্ত্র পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। এখন একবারেই বন্ধ হল রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি। এর মধ্যেও আরও কয়েকটি বন্ধের খবর পাওয়া যায়।

গত কয়েক বছর ধানের দাম না থাকায় কৃষকেরা ক্রমশ ঝুঁকছিলেন পাটের দিকে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এবার দাম না পেয়ে চাষিরা পাট চাষে আগ্রহ হারালে উৎপাদন কমে যাবে। তাতে সঙ্কটে পড়বে বেসরকারি পাটকলগুলোও।

 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এই গবেষক বলেন, “কৃষক যদি জানত পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, তাহলে তারা পাটের চাষ না করে শাকসবজি বা অন্য কিছুর চাষ করত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত পাটের আঁশের প্রায় ৫১ শতাংশ পাটকলগুলোয় ব্যবহৃত হয়, ৪৪ শতাংশের মতো কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় এবং মাত্র শতাংশের মতো লাগে ঘর-গৃহস্থালি আর কুটিরশিল্পের কাজে।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে তা .-. লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। এরপর থেকে তা আরও বাড়ছে।

আগে ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন - লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।

সরকারি হিসাবে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ হলেও কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন- প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, পরিবহন/স্থানান্তর বিপণন ইত্যাদিতে জড়িত।

আঁশ ছাড়ানোর পর পাওয়া পাটকাঠি গ্রামে জ্বালানির প্রধান উৎস; পাটচাষ কমে গেলে পাটকাঠি না পেয়ে বৃক্ষ নিধনের প্রবণতা বাড়তে পারে, যা পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।

কৃষিবিদরা বলছেন, পাট চাষ কৃষকদের অন্য পেশায় বা অন্য স্থানে পেশার তাগিদে উপার্জনের জন্য স্থানান্তর কমাতেও ভূমিকা রাখে।


No comments

Powered by Blogger.